একটি শিক্ষনীয় ঘটনাঃ
মেঘাচ্ছন্ন
সকালে বের হলাম ক্লাস করার উদ্দেশ্যে । বের হতেই মনে হল আজ দিনটা কেমন জানি
অন্যরকম । বৃষ্টি হবে হবে বলে মনে হয় কিন্তু বৃষ্টি আসার কোন নামগন্ধ নেই । এই রকম
পরিবেশে মনে পড়ে যায় কিছু স্মৃতি যা মানুষকে অন্য রকম অনুভূতিতে নিয়ে যায় । বের
হতেই না হতেই আমার বন্ধু অমিতকে দিলাম ফোন । তাকে বললাম, “তুই তাড়াতাড়ি বের হ,
আজকে রিকসা করে ক্লাসে যাব ” শুনেই সে খুব মহাখুশি । আসলে সে দিন ঐরকম আবহাওয়ায়
কেমন জানি একা যেতে ইচ্ছে করছিল না । যাই হোক আমরা দুইজনেই মনের আনন্দে ক্লাসের
উদ্দেশ্যে বের হলাম । রিকসা ভাঁড়া নিয়ে সেদিন তেমনটা তর্কাতর্কি করলাম না । রিকসা করে যাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি আজ হয়তোবা
ভালো কোন কিছু ঘটতে যাচ্ছে । যেতে যেতে অনেক কথা হচ্ছিল আমাদের মধ্যে । আরেকটা কথা
বলে রাখি –আমার বন্ধু অমিত একটু রোমান্টিক । সে তার প্রতিদিনের কথা শুরু করে কোন না
কোন রোমান্টিক বিষয় নিয়ে । এটা তার একটা চমৎকার গুণ বলা যেতে পারে । অবশেষে ক্লাসে
পৌছালাম প্রায় ১৫ মিনিট পর । ক্লাসে গিয়ে আরো দুই বন্ধুর সাথে গ্রিটিংস করলাম ।
তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল অনেকক্ষন ধরে । এটাই তো প্রকৃত বন্ধুত্ব । ক্লাস
শেষে আমরা চারজনই বের হলাম রাজ্য দর্শন করার জন্য
। অর্থাৎ কোন রাজ্যের রাজা যেমন মাঝে মাঝে তার রাজ্য ভ্রমণ করার জন্য বের
হয় তেমনি আমরাও স্মার্ট পোশাকে বের হলাম প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য । আবহাওয়া
ছিল পুরোপুরি শান্ত , কোমল এবং গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল । মেঘপুর্ণ আকাশ ও প্রতিটি
বৃষ্টির ফোঁটা আমাদের ভ্রমণের আনন্দটাকে আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে দিল । কয়েকটা স্কুল
পরিদর্শন করে আমরা উপস্থিত হলাম একটি ক্ষনস্থায়ী চায়ের দোকানে । যেটাকে আমরা মামার
দোকান বলে চিনি । দোকানের দক্ষিণ দিকে বিশাল স্কুলের মাঠ থাকাতে চমৎকার মৃদুমন্দ
বাতাস মাঝে মাঝে আমাদের গায়ে এসে আছড়ে পড়তে লাগল । আমাদের আড্ডা চলছিল অন্যরকম
ভাবে । স্বাভাবিক আড্ডার চেয়ে একটু ভিন্ন কিছু যা ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয় । আড্ডা
শুরু হল চা আর সিংগারা দিয়ে । অনেক বিষয় নিয়ে কথাও হচ্ছিল আমাদের মাঝে । সাথে
সিগারেট ও আছে । তবে আমি ও আমার আরেক বন্ধু সিগারেট তেমনটা খাই না । আর বাকী দুই বন্ধু জবর ভাবে টানছে ।।
কথা বলতে বলতে হটাৎ সেখানে দুই আগন্তুকের উদয় হল । আমার যে বন্দুটা সিগারেট পছন্দ
করে না সে বলতে লাগল , “এই ফেলে দে! ভদ্র মানুষ আসছে” । তখন সেই সিগারেট হাতে বন্ধুটি
তাজ্জব হয়ে গেল । সে দেখতে পেল যে মানুষদুটো এসেছে তার মধ্যে একজন তার স্কুলের
প্রধান শিক্ষক । সে তখন তাড়াতাড়ি সিগারেট ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং সালাম দিল । আমাদের
উঠে যাওয়াটাকে তিনি হয়তো ভদ্রতা ভেবে বসেছিলেন ।কিন্তু আমাদের
আসলে যাওয়ার সময় এসেছিল তাই আমরা উঠে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম । এমন সময় তিনি (শিক্ষক) একটু পার্টে উঠে গেলেন ।
তিনি তখন আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন একটু আক্রমনাত্নক ভঙ্গিতে । এক্ষেত্রে বলে
রাখি আমি তখন সবার কাছ থেকে দূরে গিয়ে দোকান্দারকে টাকা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম
। তিনি আমার এইধরনের আচরণ কে বোদহয় ভালো
চোখে দেখলেন না । সবাই তখন পরিচয় দিল আমরা সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি
বিভাগে পড়ি । তখন তিনি বলতে লাগলেন, “তোমাদের ডিপার্মেন্টে সবার সাথে আমার ভালো
পরিচয় আছে। তোমাদের সুজিত দত্ত নামে একজন টিচার আছে। চৌধুরি মোহাম্মদ আলী নামেও
একজন সিনিয়র টিচার আছে। আর তোমাদের চেয়ারমেনের নাম –“আজমিরি বেগম” । তাই না? ” তখন
আমার এক বন্ধু বলতে লাগল, আসলে স্যার “আজমিরি বেগম” না । উনার নাম হচ্ছে “আজমিরি
আরা” । তিনি বললেন, “আমরা আজমিরি বেগম বলেই ডাকি” ঊনার স্বামী আবার সিনেটের সদস্য । আমাদের
এলাকার মানুষ আমার ভালো একজন বন্ধু । প্রায় সময় আমরা আড্ডা দিই । আমি তারপরোও
পাত্তা দিচ্ছি না ঊনার কথাকে । কারণ ওনার ভাষাগুলো কেমন জানি আক্রমণাত্নক ধরণের ।
তাই আমি দূর থেকে শুনতে থাকলাম । আমার বন্ধুরা যখন বলল যে তারা ইংলিশে অনার্স করছে
। তখন উনি ইংরেজিতে একটা প্রশ্ন করলেন খুব দ্রুত গতিতে , “Tell me what the parts of
speech it is? . আমার
বন্ধুরা তখন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল । তখন উনি বললেন , “আমার কথা বুঝনাই মনে হয়”।
হটাত আমার দিকে নজর পড়ল । তখন তিনি আমাকে
ডেকে বললেন, “এই ছেলে তোমার স্কুল কোথায় ছিল?” উত্তরে আমি আমার স্কুলের নাম বললাম
। তিনি বললেন , কেউ কিছু বললে শুনতে হয় । এটাই ভদ্রতা । তখন আমি শুনতে লাগলাম ।
যাকে তিনি প্রশ্নটা করলেন সে বলল, “স্যার, অনার্স শব্দটা adjective+noun” তখন তিনি বললেন, বাকি আরো ৬ টা বললে ক্ষতি কি
? এতে আমার বন্ধুরা ক্ষুন্ন হল। তখন তিনি
হটাৎ করে ফোন রিসিবি করলেন , তারপর আমাদেরকে বললেন, “তোমাদের চেয়ারমেনের হাজবেন্ড ফোন
দিয়েছে” । ফোন রিসিব করে বললেন, “আপনি অনেক দিন বাঁচবেন । একটু আগে আপনার কথাই
হচ্ছিল” । হটাৎ ফোন কেটে গেল । তিনি আবার ফোন করার ভান করে রিং দিলেন। রিং দিয়ে বলত লাগলেন, “আপনাদের ইংলিশ
ডিপার্টমেন্টের কিছু ছাত্রের সাথে কথা হচ্ছিল। এরা নাকি ২য় বর্ষের ছাত্র”। এই কথা
বলে আমার দিকে তাকালেন । আমি তখন সাবধান হয়ে যায় এবং মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম না জানি
কি বলে । যদি আমাদের নামে বদনাম করে তাহলে তো আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই অপমান হবে ।
তখন তিনি বললেন, “আপনি এই দিকে আসবেন নাকি? আসলে তো এককাপ চা খওয়া যেতে পারে এবং
কিছু কথা বলা যেতে পারে ।” এই বলে তিনি ফোনটা রেখে দেন । তারপর বললেন,”এই ছেলে,
স্কুল মাষ্টার আর স্টেশন মাস্টারের মধ্যে পার্থক্য বোঝ নাকি ” আমরা তো অবাক হয়ে
শুনতে লাগলাম এবং চুপ মেরে রইলাম । “এই ধরণের বিভিন্ন প্রশ্ন BCS পরীক্ষায় এসে থাকে । CSP তেও আসত । তোমরা সিএসপি বোঝ ?” আমি উত্তরে বললাম, “পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস” ।
তিনি বললেন, “সিভিল সার্ভিস অভ পাকিস্তান, যেটা বিসি এস থেকেও আরো উন্নত ” । আমি
তখন মনে মনে হাসলাম এই ভেবে যে, এখানে সিএসপি এর কথা আসবেই বা কেন ? বর্তমানে
বিসিএস হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সরকারী চাকুরি পরীক্ষা । সিএসপি আজ থেকে ৪৫ বছর আগে ছিল
। আর কোন দেশে বিসিএস ও সিএসপি একসাথে বিদ্যমান থাকলেইতো আমরা এদের মধ্যে কে বড় আর
কে ছোট তার তুলনা করতে পারব । তার কথা শুনে মনে হল তার মধ্যে পাকিস্তানের আঁশটে
গন্ধ এখনো লেগে আছে । এরপর তিনি সেই
অনার্স শব্দটার উত্তর দিলেন । তিনি বললেন , “ শব্দটা noun হবে” । আমি তখন বললাম স্যার , “I am a honours student/ He is a student of honours 1st
year. ” উপরের
দুই বাক্যের মধ্যে দুইটাই কি noun হবে?
তিনি বললেন, যে কোন ডিগ্রিই noun হবে।
আমি যখন চুল চেরা বিশ্লেষণ করতে গেলাম তিনি আর আমাকে সময় দিতে চাচ্ছেন না । তিনি
বসে পড়লেম এবং বাকী মানুষটির সাথে কথা বলা শুরু করলেন । তারপর আমরা বিদায় নিয়ে চলে
আসলাম । এরপর যখন আমার আরেক বন্ধুর সাথে কথা গুলো শেয়ার করলাম তখন সে বলে, “ উনি
স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন এটা ঠিক কিন্তু দুর্নীতির দায়ে ওনাকে বহিস্কার করা হয়
। ” সার্টিফিকেট নকল করে তিনি নাকি ঐ স্কুলের হেড টিচার হয় । তাহলে প্রিয় পাঠক
আপনারাই বলেন ঐ তথাকথিত ভদ্রলোক আমাদের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের সদস্যের সাথে
কথা বলেছিলেন তা কি আসলেই সঠিক ? নাকি স্রেফ লোক দেখানো ? আমার মনে হয় এটা হচ্ছে দারুণ
একটা টেকনিক যা মনোযোগ আকর্ষন করার জন্য বিভিন্ন মানুষরা ব্যবহার করে থাকে স্থান, কাল,
পাত্র ভেদে । আমি বাসাই এসে কিছু যুক্তি হাজির করলামঃ
১। উনি আমাদের
সবার স্কুলের নাম কেন জেনে নিলেন আগে থেকে?
২। আমরা
যে ২য় বর্ষে পড়ি তা দুই বার করে জেনে নিলেন কেন ?
৩। আমি যে
বিভিন্ন উত্তর দিচ্ছি তা তিনি কোন পাত্তাই দিচ্ছেন না কেন ?
৪। আমাদের
ডিপার্টমেন্টের শুধুই কেন CMA স্যার আর
আজমিরি ম্যাডামের কথা বললেন ? বাকি স্যার দের নাম উচ্চারণ করলেন না কেন ?
৫। আমরা
যে সময় কথা বলছিলাম সেই সময় কেন আমাদের চেয়ারমেনের হাজবেন্ট ফোন দিলেন ?
৬। তিনি
কি ফোন করার অন্য কোন সময় পেলেন না ?
৭। প্রথমবার
তিনি ফোন কেটে দিয়ে আবার ফোন করলেন কেন ? এটা কি নিছক পাতানো খেলা ?
৮। উনি প্রথমে ইংরেজিতে প্রশ্নটি করলেন খুব দ্রুত ভাবে
। কিন্তু বাকি সময়তে কোন ইংলিশে প্রশ্ন করলেন না কেন ?
এই ধরণের
কঠিন প্রশ্ন করে আমাদের কনফিউজড করার উদ্দেশ্যটাই
বা কি ? উনার কথাগুলের মধ্যে কোন ধারাবাহিকতা নাই । হঠাত করে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন
করছেন । প্রিয় পাঠক আপনারাই বিচার করেন কিভাবে যে আমরা প্রতিদিন এভাবে ছলনারুপ ভাইবার
শিকার হচ্ছি । নিজেকে জাহির করার জন্য এভাবেই বিভিন্ন পন্থা দুষ্ট হৃদয়ের মানুষেরা
ব্যবহার করে থাকে । এই কথাবার্তা থেকে অনেক কিছু কি শিক্ষা নেওয়া যায় না ?